আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে বছরে চুরি হচ্ছে দেড় কোটি টাকার ডিজেল
Image credits: Prothom Alo
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আমিনবাজার ল্যান্ডফিলের (স্থায়ী বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র) ১০টি ভারী যানযন্ত্রের (এক্সকাভেটর, চেইনডোজার ও টায়ারডোজার) জন্য গত ১ আগস্ট ২ হাজার ৭৭০ লিটার ডিজেল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যানযন্ত্রগুলোতে সেদিন ডিজেল ভরা হয় ২ হাজার ৩৬৬ লিটার। বাকি ৪০৪ লিটার ডিজেল আত্মসাৎ করেন ল্যান্ডফিলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। লিটার ১০৭ টাকা হিসাবে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ২২৮ টাকা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ডিজেলের রশিদ, ফিলিং স্টেশনের ডিজেল সরবরাহের প্রতিবেদন ও অয়েল ট্যাংকার (যে গাড়িতে পাম্প থেকে ডিজেল ল্যান্ডফিলে নেওয়া হয়) থেকে যানযন্ত্রে ভরা জ্বালানির রসিদ বিশ্লেষণ করে আত্মসাতের এই হিসাব পাওয়া গেছে। বর্জ্য বিভাগের বরাদ্দ ও ফিলিং স্টেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেদিন ল্যান্ডফিলের চেইন এক্সকাভেটর ১, ২ ও ৩-এর প্রতিটিতে ২৮০ লিটার করে ডিজেল বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই তিনটি যানযন্ত্রে ডিজেল ভরা হয় ২৬৬ লিটার করে। প্রতিটিতে ১৪ লিটার করে মোট ৪২ লিটার ডিজেল কম ভরা হয়। ওই দিন চেইন এক্সকাভেটর-৯–এর জন্য বরাদ্দ ২৮০ লিটার ডিজেল না ভরে পুরোটাই আত্মসাৎ করা হয়। বাকি ছয়টি যানযন্ত্রে দেওয়া বরাদ্দ থেকে ৪ থেকে ২৮ লিটার করে কম ভরে সেদিন আরও ৮২ লিটার ডিজেল আত্মসাৎ করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। তবে ল্যান্ডফিলের কর্মকর্তাদের দাবি, ফিলিং স্টেশন থেকেই কম ডিজেল দেওয়া হয়। আর ফিলিং স্টেশন কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, সিটি করপোরেশনের রসিদ অনুযায়ী ডিজেল দেওয়া হয়; কম দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। যদিও নিজেদের দাবি অনুযায়ী, কম জ্বালানি দেওয়া নিয়ে ফিলিং স্টেশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। আর ফিলিং স্টেশন কর্তৃপক্ষও সঠিক পরিমাণে ডিজেল দেওয়ার প্রমাণ দেখাতে পারেনি। বছরে দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ ১ আগস্ট ছাড়া আরও কয়েক দিনের জ্বালানি তেল বরাদ্দের হিসাব নিয়েছে প্রথম আলো। এর মধ্যে গত ২৯ জুলাই ১০টি যানযন্ত্রের জন্য ২ হাজার ৯৮০ লিটার ডিজেল বরাদ্দ হয়। ফিলিং স্টেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরাদ্দের পুরোটাই পাম্প থেকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অয়েল ট্যাংকারের রসিদ অনুযায়ী, সেদিনও একটি যানযন্ত্রে ডিজেল ভরা হয়নি। অন্যগুলোতেও পরিমাণে কম ডিজেল ভরা হয়েছে। সব মিলিয়ে সেদিন ৩৪৮ লিটার ডিজেল কম ভরা হয়। এ ছাড়া ২৯ জুলাই ৩৪৮ লিটার আর ১ আগস্ট ৪০৪ লিটার ডিজেল কম ভরা হয়। গড় হিসাবে দিনে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭৬ লিটার। লিটার ১০৭ টাকা দরে এর বাজারমূল্য ৪০ হাজার ২৩২ টাকা। এই হিসাবে বছরে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার ৬৮০ টাকার ডিজেল আত্মসাৎ করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুভাবে ডিজেল চুরির টাকা আত্মসাৎ করা হয়। প্রথমটি, ফিলিং স্টেশন থেকে পরিমাণে কম ডিজেল নিয়ে। এর সুবিধা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কালেকশন অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন (সিঅ্যান্ডটি) শাখার প্রকৌশলীরা পান। দ্বিতীয়টি, কম সময় যানযন্ত্র চালিয়ে। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কম সময় যানযন্ত্র চালিয়ে জ্বালানি বাঁচান অপারেটররা (চালক)। পরে কৌশলে বাইরে নিয়ে বিক্রি করে দেন। এ বিষয়ে সিঅ্যান্ডটির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে বিদ্যুৎ শাখার দায়িত্বে) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ল্যান্ডফিলে অনেক কিছু হয়। আমার পর্যন্ত এগুলো আসত না।’ ভাগ পান সবাই ল্যান্ডফিলে কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও ডিজেল বরাদ্দের কাজ করেন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মুহাম্মদ মনির হোসাইন ও বিদ্যুৎ হোসেন। ডিজেল চুরির বিষয়ে মনির হোসেন বলেন, বাস্তবে পাম্প থেকে ১০০ লিটারে ৫-৬ লিটার কম দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ হোসেনও পাম্প কর্তৃপক্ষের ওপর দায় চাপিয়ে বলেন, পাম্প থেকে ৫ শতাংশের বেশি তেল কম যায়। ঢাকা উত্তর সিটি ল্যান্ডফিলের জন্য জ্বালানি তেল নেয় মহাখালীর সিএম সার্ভিসিং স্টেশন লিমিটেড থেকে। অভিযোগের বিষয়ে পাম্পের পরিচালক আশিক আদনান তেল (ডিজেল) কম দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। ডিজেল চুরির বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচজন কর্মকর্তা ও ছয়জন চালকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। কর্মকর্তাদের একজন নাম না প্রকাশের শর্তে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা ভাগে পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। সিঅ্যান্ডটির নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে ওই টাকা দেওয়া হতো। উত্তর সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জ্বালানি নিয়ে কোনো দুর্নীতি হচ্ছে কি না, ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে কাজ করছি। দুষ্কৃতকারীদের ধরতে চাই। অতি শিগগিরই এটা ঘটবে।’